m
ছবি: ভরের কাগজ

আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল টানা একুশ বছর। সংখ্যা হিসাবে বিএনপির সেখানে যেতে বা একুশ বছর হতে আরো ৪ বছর বাকি। গত ১৭ বছর ধরে ক্ষমতাহীন দলটি পোহাচ্ছে নানা ঝক্কিঝামেলাও। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় : প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন কঠিন সময় আর পার করেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির বিরোধী দলে থাকা ও দুর্গতি পোহানোর সময়, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট একবারে ভিন্ন। রকমফের বিস্তর। এরপরও বিএনপি মহাসচিবের আশা, ‘সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র’। কোন ভরসা বা সিগনালে এমন আশাবাদ তার? নাকি তা কেবলই কর্মীদের চাঙ্গা রাখার কৌশলী আস্ফালন?- এ প্রশ্নের জবাব নেই। দৃশ্যত এখন পর্যন্ত সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ার মতো রাজপথের আন্দোলন বিএনপি জমাতে পারেনি। ভরসা বলতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশের নেকনজরে কামিয়াবি অর্জন। মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে। বিভাগীয় শহরগুলোতে তারা ধারাবাহিকভাবে জনসভার আয়োজন করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে তা একটি পরিণতি পাবে, তেমন আশা বিএনপির অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে দলটি তার শক্তি-সামর্থ্য ও জনসমর্থনের বিষয়টি প্রমাণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ফল তারা পায়নি। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে আশাবাদ ধরে রাখা কঠিনের চেয়েও কঠিন। এ কঠিনকে জয় করতে দলটির নজর বেশি- বিদেশি কূটনীতিকদের দিকে। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে ‘বিদেশি চাপকেই’ এই মুহূর্তে অধিকতর ভরসা মনে করছে বিএনপি। তবে প্রকাশ্যে বলতে হচ্ছে রাজপথের আন্দোলনের কথা। কিন্তু বারবার ঘোষণা দিয়ে সরকার হটানোর ‘চূড়ান্ত’ আন্দোলন নিয়ে এখনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ধোঁয়াশা-জিজ্ঞাসা দুটাই জোরদার।
এর মাঝেই কোনো না কোনো দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক-যতœআত্তি করতে হয় বিএনপিকে। সেই সঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক এখন বিএনপির রুটিন ওয়ার্কের মতো। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় দেশে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিশ্চিতের আশা তাদের। বিএনপি নেতাদের মতে, ২০১৪ এবং ১৮ সালে সরকার একতরফা নির্বাচন করলেও তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। সেই বিশ্বাসে এরই মধ্যে পদযাত্রা, মহাসমাবেশ, রাজধানীর প্রবেশ মুখে অবস্থান ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে দলটি। তবে এসব কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে হচ্ছে নানা নাটকীয়তা। কখনো কখনো মহাসচিবও জানেন না, কি কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিশেষ নির্দেশনায় যে কোনো সময় কর্মসূচির ধরন, স্থান ও সময় পরিবর্তন হয়ে থাকে। কর্মসূচির এক ঘণ্টা আগেও খোদ বিএনপির নেতারাই অন্ধকারে থাকেন কর্মসূচির বিষয়ে। এমনকি একটি কর্মসূচি চলাকালেও পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে কি না, কোথায় কবে হবে পরবর্তী কর্মসূচি- তাও অজানা থেকে যায়। যা দলে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে গত ২৯ জুলাই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ডিবি অফিসে ভূরিভোজন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফল পাঠানোর পর থেকে নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। যদিও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আমান উল্লাহ আমান সেদিনের বিষয় নিয়ে ব্যাখা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। এর মাঝে আবার দলে ভর করেছে শুদ্ধি অভিযান। চলমান আন্দোলনে গাফিলতি পেলে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। অব্যাহতি, বহিষ্কারের মতো অ্যাকশন নামছে। তা বেশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের আশাব্যাঞ্জক ভূমিকা না থাকায় পদচ্যুত করা হয়েছে ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে। ভেঙে দেয়া হয়েছে যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি। আনা হয়েছে নতুন নেতৃত্ব। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, এগুলো দলের রুটিন মাফিক কাজ। এখানে নেতাকর্মীদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে একটি মহল মূল্যায়ন রিপোর্টের নামে ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার একটি অপচেষ্টার অভিযোগ আছে। একটি চক্র তাদের বলয়ের নেতাদের দলের বিভিন্ন পদে বসাতে এমনটি করছেন বলে কথা চালাচালি রয়েছে। বাইরে পুলিশের ধাওয়া আর দরে ভেতরে শাস্তির তাওয়া মিলিয়ে নতুন একটি আবহ চলছে বিএনপি, বিশেষ করে অঙ্গ-সহযোগী দলগুলোতে। গোলমালটা বেঁধেছে সরকার পতন আন্দোলনের ঘোষণা দেয়ার পর ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশ শেষে ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে। চাপটা বেশি পড়ে যায় তাদের ওপর। যে কারণে ২৯ জুলাইতে নেতাকর্মীদের কয়েকজন আশাব্যাঞ্জক পারফরম্যান্স রাখতে পারেননি। ২৮ জুলাই রাজধানীতে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে ২৯ জুলাই অবস্থান কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে বলা হয়, আপনারা যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন কেউ যাবেন না। অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে একদফা আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে সহযোগিতা করবেন।
নেতাদের এমন বক্তব্যে মফস্বল থেকে আসা অনেক নেতাকর্মী সেদিনের কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং মফস্বলের অসংখ্য নেতাকর্মী ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হন। এমনকি অনেকে পুলিশ ও সরকার দলীয় সমর্থকের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। কিন্তু সেখানে রাজধানীকেন্দ্রিক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল নগণ্য। অনেকের মতে সেদিন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর পুলিশি হামলা না হলে এ কর্মসূচি সুপার ফ্লপ হতো। গয়েশ্বরের ওপর হামলা ওই কর্মসূচিকে আলোচনার খোরাক দিয়েছে। ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচির পর একটি মূল্যায়ন রিপোর্ট করা হয়েছে দলের একটি গ্রুপ থেকে। এতে কর্মসূচির দিন দলটির কোন কোন নেতা গাফিলতি করেছেন তার চিত্র তারেক রহমানকে জানানো হয়। সেদিনের কর্মসূচিতে গাফিলতির বিশেষ অভিযোগেই ছাত্রদল সভাপতি পদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে শ্রাবণকে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা সহ-সভাপতি রাশেদ ইকবাল খানের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ। এ ঘটনার আগে, আরেক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চার বছর পর ছাত্রদল থেকে বহিষ্কৃত ১১ নেতার সাংগঠনিক সাজা তুলে নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২২ জুন বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের। রাষ্ট্র মেরামতের দফা দেয়া দলটির ভেতরেই এমন মেরামতহীনতা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।
বৈশ্বিক ও ভূ-রাজনীতিসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবার বাংলাদেশ প্রশ্নে যে পর্যায়ে চলে এসেছে সেখান থেকে তাদের ব্যাক করার অবস্থা নেই। বিএনপির জন্য এটি মোটা দাগের আশা-ভরসা। সেই ভরসায় তারা ‘শিগগির’ সরকার পতনের আশা দেখে। এর মাঝেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আবার অসুস্থ। বিএনপির প্রতি সরকারের বার্তাও বেশ কঠিন। বিএনপিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে সরকারও কঠোর অবস্থানে যাবে। জামিন বাতিল করে খালেদা জিয়াকে আবার কারান্তরীণ করার প্রচ্ছন্ন হুমকিও আছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত কারান্তরীণ হন। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে তার মুক্তির জন্য আন্দোলনের চেষ্টা করা হলেও তা জমানো যায়নি। আইনগত প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্তির চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এরপর দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় বেগম জিয়া কখনো সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে কখনো বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহানার সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার এবং বোন সেলিমার মধ্যস্থতায় খালেদা জিয়াকে অন্তত কারাগার থেকে ফিরোজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
ঢাকায় মহাসমাবেশ ও ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির পর তাদের আন্দোলনের যে গতি বা টেম্পু ওঠার তা হয়নি। বিএনপির মহাসমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়েছে। বিএনপির অনেকেই একে ওই সমাবেশের বড় চমক বলে মনে করেছেন। অথচ তার বক্তব্য প্রচারে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং সে কারণে দলটিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পরের জনসমাবেশটি করতে হয়েছে ‘দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য প্রচার করা যাবে না’, এমন শর্তে। সচিবালয় ঘেরাও, অবরোধ, বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওর মতো গরম কর্মসূচির কথা উড়ছিল বাতাসে। হয়েছে দমে যাওয়ার মতো উল্টোটা। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনের একটি মামলায় দণ্ড। তার ওপর খালেদা জিয়ার অসুস্থতা। দলের কর্মীদের উচ্ছ¡াস পরবর্তী হতাশা কিছু প্রশ্নকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের মতো একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে হলে বিএনপির কী দশা হবে- এ প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
[email protected]


সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।