fabbdbcbcecc dcd
ছবি: আজকের পত্রিকা

আজন্ম পাকিস্তানি দিলের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু হয়েছে ১৪ আগস্ট (২০২৩)। শেষ জীবনে বাংলাদেশ সরকারের ভরণপোষণে কারাগারে ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এলাকায় তাঁর কুখ্যাতি ছিল ‘দেল্লা রাজাকার’ নামে। মানবতাবিরোধী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি গুরুতর পাঁচটি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। পরে আপিল করলে উচ্চতর আদালত সেই দণ্ডাদেশ কমিয়ে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।

সাঈদীর মৃত্যুর দিনটি ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। কাকতালীয় ঘটনা হলেও মনে হয়, জীবনভর পাকিস্তানপ্রেমী সাঈদীর আত্মা যেন এই দিনটির অপেক্ষায়ই ছিল। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর পাকিস্তানপ্রীতি সার্থক হয়েছে। সেদিনের আরেকটি কাকতালীয় ঘটনা—দেশে মধ্যমাত্রার ভূমিকম্প। এই প্রাকৃতিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত কারণ আমরা জানি। এর পৌরাণিক ব্যাখ্যা বিভিন্ন ধর্মে একেক রকম। ষাঁড়ের শিং বা বাসুকি নাগের ফণার ওপর পৃথিবী দণ্ডায়মান। পাপে পূর্ণ হয়ে গেলে এর ভার বহন করা কষ্টকর হয় বলে পৃথিবীকে এক শিং থেকে অপর শিঙে বা বাসুকির এক ফণা থেকে অন্য ফণায় স্থানান্তর করে। তখনই হয় ভূমিকম্প।

অবৈজ্ঞানিক সেই সব কথা যারা অযৌক্তিকভাবে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে করুক, কোনো বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তিবাদী মানুষ তা বিশ্বাস করে না। তাই অন্ধবিশ্বাসীদের এ কথাও বিশ্বাস করার কারণ নেই যে সাঈদীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ভূমিকম্প হয়েছে। আদালত কর্তৃক প্রথম সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর তাঁকে চাঁদে দেখা গেছে এমন অপপ্রচারও কেবল মিথ্যাচার নয়, মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধীদের আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রচারের অপকৌশল।

সাঈদীর মৃত্যুর পর এ দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। অসংখ্য মানুষ তাঁদের ফেসবুক আইডিতে সাঈদীর পক্ষে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। তাঁকে মহাপ্রাণ ধার্মিক, আল্লামা ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে প্রায় মহাপুরুষ বানিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের দুঃখ প্রকাশ ও হা-হুতাশের ধরন দেখে মনে হয়, ইসলামের মহাখিদমতগারের মৃত্যু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এক ধর্মব্যবসায়ীর মৃত্যু নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও কেউ কেউ ফেসবুকে হা-হুতাশ করে সচিত্র স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

সাঈদীর মৃত্যুর পর গণযোগাযোগমাধ্যমে চোখ রেখে বোঝা গেছে, স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরেও এ দেশে পাকিস্তানপ্রেমী ও চাঁদ-তারা পতাকার অভিলাষী আলবদর-রাজাকারের ছানাপোনা কম নেই! অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু ভেতরে পাকিস্তানপ্রেমী। সেই সব মুখোশধারীর প্রকৃত চেহারা অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে। ছদ্মবেশী নাগনন্দনেরা অনেকেই মুখোশ খুলে আসল চেহারা দেখিয়েছেন।

এসব লক্ষ করে কানাডাপ্রবাসী কবি ও গবেষক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী সেদিন ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, তাঁদের বন্ধু-তালিকার কেউ যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে স্ট্যাটাস দিলে এই সব কুলাঙ্গারকে আনফ্রেন্ড করবেন। আমিও ওরকম একটি স্ট্যাটাস দিয়ে তাদের ব্লক করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। তাতে অনেকের প্রশংসা পেলেও দেখা গেছে কেউ কেউ আমাকে গালিগালাজ করেছে, কেউ হুমকি-ধমকি দিয়েছে আবার কেউ শত্রু ভেবে আমাকে ব্লক করেছে। তাতে আমি পিছপা হইনি। সব রাজাকার-শাবককে বিদেয় করে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।

আলবদর-রাজাকারের এত ছানাপোনা যে প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীর আবরণে ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে, তা এত দিন বোঝাই যায়নি! আমার মতো অনেকেই এভাবে ঘর থেকে জঞ্জাল সাফ করেছেন। এটি ‘নীরব বিপ্লব’ না হলেও অন্তত ‘বাংলাওয়াশ’ তো বটেই।

এমন সাফাই-ধোলাই অনেকেই করেছেন নীরবে-নিভৃতে। সরবে ও ঘোষণা দিয়েও এই সাফাই কার্যক্রম লক্ষ করা যায়। সহযোগী রাজনৈতিক সংগঠনেরও কেউ কেউ এই ছদ্মবেশী নব্য রাজাকার-নন্দনদের বহিষ্কার করেছেন। সারা দেশের জেলা ও মাঠপর্যায়ের এসব খবর এখন প্রায় প্রতিদিনই আজকের পত্রিকাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হচ্ছে। আজকের পত্রিকা থেকে কয়েকটি শিরোনাম ও খবরের অংশবিশেষ নিচে তুলে দিচ্ছি।

২০ আগস্ট শেষ পৃষ্ঠার খবর: ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শোক প্রকাশ করায় ফেনীতে ছাত্রলীগের ২০ নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিন জেলায় ১১ নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও যশোর।’ ২১ আগস্ট শেষ পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: ‘ছাত্রলীগের ১৬ নেতাকে অব্যাহতি’। ২২ আগস্ট প্রথম পৃষ্ঠার দুই কলামের শিরোনাম: ‘শোকে পদ হারালেন ছাত্রলীগের ২৩২ নেতা’। ২৩ আগস্ট শেষ পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম: ‘ছাত্রলীগের ১১ নেতাকে অব্যাহতি’।

২৪ আগস্ট তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়: ‘৭১-এর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মৌলবাদী ধর্ষক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী, এমপিওভুক্ত শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং নিম্ন আদালতের একজন বিচারকের সাঈদীপ্রীতি আমাদের অত্যন্ত বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে।’ এসব খবর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে কেবল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে না, ভয়াবহ পরিণামের আশঙ্কাও মনে জাগে।

তবে সুখের কথা, সেই অপশক্তিকে প্রতিরোধ এবং দমনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের এই কালসাপ-বিতাড়নকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম সোপান বলে নিশ্চয়ই আখ্যায়িত করা যায়! তবে আমাদের সমস্যা হলো ছদ্মবেশী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নিয়ে। জামায়াত-শিবির সহজে চেনা যায় কিন্তু ছদ্মবেশী পাকিস্তানিপ্রেমীদের চেনা মুশকিল! ওদের চেনার একটা বড় সুযোগ এসেছে সাঈদীর মৃত্যুর দিন থেকে। তবু সব চেনা যায় না। তাই সমূলে ওদের উচ্ছেদ করাও বোধ করি আপাত-অসম্ভব।

দ্বিচারিতা ও বর্ণচোরা স্বভাব বর্তমান নতুন প্রজন্মের মধ্যে যেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লক্ষ করা যায়, তেমনি জ্ঞানপাপীর সংখ্যাও কম নয়! সত্যিকার ইতিহাসপাঠে অনীহাই এর মূল কারণ। দ্বিমুখী সাপের মতোই তারা কখনো এমুখো কখনো ওমুখো। তাই বাংলার লোকছড়ার কথাই সত্য বলে মানতে হয়, ‘একই গাছে পান-সুপারি/ একই গাছে চুন,/ কিবা দেশের গুণরে ভাই/ কিবা দেশের গুণ…।’

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক, গ্রন্থকার


সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।